সেলিম হায়দার : মৃৎশিল্প বাঙালির ঐতিহ্যের সাথে যুগের পর যুগ মিশে থাকলেও প্লাস্টিক পণ্যের আগ্রসী বিজ্ঞাপনে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রচীন এ শিল্পটি। বর্তমানে দেশের অসংখ্য মৃৎশিল্পী তাদের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পেশা ছেড়ে দিয়ে ঝুঁকছেন ভিন্ন পেশায়।
যারা কোন উপায় না পেয়ে এ পেশায় রয়েছেন তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। দেশের মৃৎশিল্পের এমন যখন টালমাটাল অবস্থা তখন দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের অবস্থা ভিন্ন। মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত পুরাতন উপকরণ বাদ দিয়ে আধুনিক যন্ত্রকে বেছে নিয়েছে এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা। আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নান্দনিক সব মাটির পণ্য। যা স্থানীয় বাজারে তৈরি করেছে বিশেষ চাহিদা।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মৃৎশিল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া হচ্ছে আধুনিক মাটির পণ্য উৎপাদনের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক যন্ত্র। তালা উপজেলা সদরের কপোতাক্ষ নদীর তীরের কুমোরপাড়ায় (পাল পাড়া) গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে আধুনিক মাটির পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন মৃৎশিল্পী ও উদ্যোক্তারা।
শিবপুব পালপাড়ার বাসিন্দা মৃৎশিল্পী জয় পাল বলেন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মৃৎশিল্পের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমাদের অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। তবে বর্তমানে আমাদের পেশা টিকিয়ে রাখতে উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে এখানকার মৃৎশিল্পীদের দৃষ্টিনন্দন, টেকশই মাটির পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ ও যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা আধুনিক মানের মাটির কাপ-পিরিচ, প্লেট, ফুলদানি, টেরাকাটা, ওয়াল টাইলসসহ নান্দনিক সব পণ্য তৈরি করতে পারছি। বাজারে এসব পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দামও ভালো পাচ্ছি।
এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। আগামীতে বিদেশে গেলে আমাদের আয় বৃদ্ধি পাবে। মৃৎশিল্পী রামপদ পাল জানান, ‘আধুনিক মাটি প্রক্রিয়া মেশিনে প্রস্তুতকৃত মাটি দিয়ে জিগার মেশিনের সাহায্যে খুব সহজেই নান্দনিক ডিজাইনের স্বাস্থ্যসম্মত দইয়ের খুলি, ফুলের টব, ফুলদানি, কাপ-পিরিচ, মগ ও প্লেট তৈরি করা যায়। এই মেশিনে উন্নত মানের পণ্য তৈরি করতে পারায় ক্রেতাদের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভালো বাজার মূল্য পাচ্ছি আমরা।’
উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রকল্প কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ বলেন, ‘উন্নত মানের মাটির পণ্য তৈরিতে মৃৎশিল্প উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা করছে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন প্রচেষ্টা । পাশাপাশি আধুনিক জিগার মেশিন, মাটি প্রক্রিয়ার আধুনিক যন্ত্রসহ পরিবেশ বান্ধব চিমনি স্থাপন করে দিচ্ছেন তারা। দুই বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা জেলার মোট ৪০০ জন মৃৎশিল্পী ও উদ্যোক্তা এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। প্রশিক্ষণ শেষে সহজ শর্তে পাবেন ঋণ।
এ ব্যাপারে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ড. ফজলে রাব্বী সাদেক আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মৃৎশিল্প ও সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র উদ্যোগ সমূহকে আধুনিকায়ন, পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই করার লক্ষ্যে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের (এসইপি) উপ-প্রকল্প পটারি বাস্তবায়ন করছে উন্নয়ন প্রচেষ্টা।
আর এই উপ-প্রকল্পের হাত ধরেই এ অঞ্চলের হারাতে বসা মৃৎশিল্প আজ নব যৌবন ফিরে পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখান থেকে উন্নতমানের মাটির পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে মৃৎশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে। একই সাথে এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।’