শেখ ইফতেখার আল মামুন (সুমন), কপিলমুনি : খুলনার ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীনবাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে খ্যাত আধুনিক কপিলমুনির রূপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ৮৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ৩রা মাঘ (বুধবার)। তিনি ১৩৪১ বঙ্গাব্দের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯০ খিষ্টাব্দের ২০ মে প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী সাধু খাঁ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ। তার পিতার নাম যাদব চন্দ্র সাধু, মাতা সহচরী দেবী।
পিতামহ ছিলেন ভরত চন্দ্র সাধু এবং পিতামহী অমৃতময়ী দেবী। পিতা-মাতার তিনি তৃতীয় সন্তান তিনি। পারিবারিক নানা সংকটে পড়া-লেখায় বেশি দূর এগুতে না পারলেও তিনি ছিলেন জনপদের অন্যতম শিক্ষানুরাগী। বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত রাড়ুলীর আর,কে,বি,কে হরিশচন্দ্র ইনষ্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেই ছাত্রজীবনের ইতি ঘটে তার।শৈশবেই পিতার হাত ধরে ব্যবসা জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। তিনি বিয়ে করেন পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। দাম্পত্য জীবনে তিনি ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক।জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
পূর্বপুরুষদের নামে কপিলমুনিতেই একে একে প্রতিষ্ঠা করেন বহু প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপদের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ মাতার নামানুসারে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবে অমৃতময়ী টেকনিক্যাল স্কুল, লেদ, তাঁত, সুগার মেশিন স্থাপন সহ অনেক উন্নয়ন মূলক কার্যক্রম।এছাড়াও নিজ উদ্যোগে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নেদেশে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করেন। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু তৎকালীণ জনপদের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নিজ অর্থায়নে পিতামহের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ২০ শয্যা বিশিষ্ঠ ভরত চন্দ্র হাসপাতাল।
তৎকালীণ বৃহত্তর খুলনায় একমাত্র এক্স-রে মেশিনটিও তার অবদান। ভরত চন্দ্র হাসপাতালে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যেমেশিনটি দেশে আনা হলে তৎকালীন খুলনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুরোধে ১৯৩৬ সালের ৮ জানুয়ারী খুলনা সদর হাসপাতালে নিজ খরচে ভবন নির্মাণপূর্বক সেখানেই এক্স-রে মেশিনটি স্থাপন করেন। আধুনিক কপিলমুনির রূপকার বিনোদ বিহারী সাধুর স্বর্ণালী ব্যবসা জীবনের (১৯৩০সাল থেকে ১৯৪১সাল) ১১ টি বছর কেটেছে এ কপিলমুনিতেই। ব্যবসা জীবনে যশ-প্রতিপত্তির ঘাটতি ছিলনা তাঁর। সমাজ সেবায় তৎকালীণ সময়ে তাঁর অবদান ছিল অনন্য।
কর্মময় জীবনে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি তথা সমাজ সেবার দৃষ্টান্ত বিরল। কপিলমুনি বাজার থেকে প্রতাপকাটী অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের জন্য নিজ অর্থেনাছিরপুর খালের উপর কাঠের পুল তৈরীএবং পাকা রাস্তা করে দেন। কপোতাক্ষ নদের উপর কপিলমুনিতে নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের জন্য ঐসময় কলকাতার সেন্ট্রাল ব্যাংকে লক্ষাধিক টাকা রেখে যান। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত যার লভ্যাংশ জমা হত কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের কোষাগারে। জনস্বার্থে বাজারের মধ্যভাগে ৬/৭ বিঘা জমির উপর মায়ের নামে পুকুর খনন করে নাম দেন সহচরী সরোবর।
নিজ প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয় ও ভরতচন্দ্র হাসপাতালের জন্য খুলনা জেলা পরিষদে তৎকালীন ৩২ হাজার টাকা রেখে যান। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির এর অর্থ যোগানে কলকাতা রিজার্ভ ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা আলাদা করেজমা রাখেন। বাংলা ১৩৩৯ সালে কপিলমুনিতে স্থাপন করেন “বিনোদগঞ্জ”। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংকের দেওয়ালে শ্বেতপাথরে লিখে যান “ভাবী বংশধর কভু না পাইবে ইহার ভবিষ্য আয়। ব্যয়িত হইবে পল্লীমঙ্গলের তরে, যে সদপ্রতিষ্ঠান পিতৃস্মৃতি রক্ষা হেতু করিনু স্থাপন, জানিব সফল মম এজনম, বিধি এ প্রানের বাসনা মোর করিলে পূরণ। আর প্রতিবেশী সদা থাকিবে সুখে, ইহার উন্নতি কামনা যদি করে অহরহ”।
বাংলা ১৩৩৮ সালের ২ কার্ত্তিক প্রতিষ্ঠা করেন সার্বজনীন বেদ মন্দির। ব্রিটিশ ভারতের রাজত্বে চার কোণে অবস্থিত বেদ মন্দিরের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য মহা পবিত্র বেদ মন্দির এটি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। যা তৎকালীণ ব্রিটিশ সরকারেরও নজর এড়ায়নি। আর এ জন্যই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় সাহেব উপাধীতে ভূষিত করে।
নিভৃত জনপদের সমাজ উন্নয়নের এ কারিগর সৃষ্টি করে গেছেন আরো অনেক প্রতিষ্ঠান, দান করে গেছেন সর্বস্ব। বাজার প্রতিষ্ঠায় জমি খরিদ করে দান, আলাদা খেলার মাঠ নির্মাণ, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় জমি দান থেকে শুরু করে নিজের বাড়িটি পর্যন্ত দান করে গেছেন জনপদের মানুষের ভাগ্যেন্নয়নে। বেরী বেরী রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩৪১ সনের ৩ রা মাঘ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। রায় সাহেবের এই মৃত্যুক্ষণকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেতার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, বিনোদ স্মৃতি সংসদ, বিনোদ স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ সহ বিভিন্ন সংগঠন বিশেষ অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করেছে। এছাড়াও রয়েছে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন।