রাবিদ মাহমুদ চঞ্চল : ১৯৭১ সাল, চারিদিকে তখন গোলাবারুদের ঝনঝনানী। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক হানাদার ও তার দোসরদের যুদ্ধ দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে। দলে দলে মানুষ প্রানের ভয়ে উদ্বাস্তু হয়ে বাড়িঘর ফেলে আশ্রয় নিতে ছুটে চলেছে ভারতে।
একাত্তরের ২০ মে ভারতগামী মানুষের পদচারনায় পরিপূর্ণ খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর গ্রামের ভদ্রা নদীর পাড়। আর এই দিনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এখানে। এক সঙ্গে ১০ হাজারের অধিক হিন্দু-মুসলমান নর-নারী ও শিশুকে সেদিন হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী।
পাকিস্তানের দোসর এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনী সেই নৃসংশ হত্যাযজ্ঞে সরাসরি সহযোগিতা করেছিল। চুকনগরের প্রতিটি বাড়ি থেকে সব বয়সের নারী-পুরষকে ধরে এনে দাঁড় করিয়েছিল নদীর পাশে একটি মন্দিরের সামনে। সেদিন সেই মন্দিরের উঠোন পরিণত হয় রক্তাত্ব শশ্মানে। খরস্রোতা বুড়িভদ্রা পানি রুপ নেয় রক্ত ধারায়। হত্যাযজ্ঞের একদিন পর সেই শ্মশানে লাশের স্তুপে নিজের পিতাকে খুঁজতে আসেন গ্রামের এক সাধারণ কৃষক এরশাদ আলী মোড়ল।
অনেক পুরুষ মহিলার লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি তার পিতার লাশ না পেয়ে চলে যাওয়ার সময় একটি শিশুর কাঁন্নার শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ান। পেছনে ফিরে দেখতে পান মহিলাদের লাশ পড়ে আছে। তাঁর মধ্যে একজন মহিলার বুকের উপর হামাগুরি দিয়ে একটি শিশু দুধ পানের চেষ্টা করছে। তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন এবং মহিলাটির দিকে তাকালেন। দেখলেন মহিলাটির হাতে ধবধবে সাদা শাঁখা মাথায় রক্তরাঙা সিঁদুর।
বুঝতে বাকি রইলো না যে মহিলাটি সনাতন ধর্মের। শিশুটির বয়স আনুমানিক ৬ মাস। কন্যা শিশুটিকে তিনি বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সনাতন ধর্মের সাথে মিল রেখে নাম রাখলেন রাজকুমারী সুন্দরীবালা। তাঁর ঘরের কোনে রাজকুমারী সুন্দরীবালার জন্য স্থাপন করলেন ঠাকুর ঘর।
উঠানে লাগালেন তুলসী গাছ। সেই সাথে শিশু সুন্দরীবালাকে শেখানো হলো গীতা পাঠ এবং হিন্দু ধর্মের যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান। এরশাদ আলী মোড়লের সাহসিকতায় এইভাবে একই ঘরে মাগরিবের আযান ও উলু ধ্বনি একাকার হয়ে গেলো। এ যেনো মানুষ ও মানবতার এক অমর গাঁথা দৃষ্টান্ত। রাজকুমারী সুন্দরীবালা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন। এক সময় এরশাদ আলী মোড়ল হিন্দু রীতি মেনে হিন্দু স¤প্রদায়ের এক সুপাত্রের সাথে সুন্দরী বালার বিয়ে দিয়ে দিলেন।
এব্যাপারে সুন্দরী বালা বলেন , সেদিন এরশাদ আলী মোড়ল যদি আমাকে কুড়িয়ে না আনতেন , তাহলে আমাকে মৃত মায়ের বুকের উপর মরতে হতো। এরশাদ আলী মোড়ল বলেন, পিতা চিকন আলী মোড়লের লাশ খুঁজতে গিয়ে হাজার হাজার লাশের মধ্যে সেদিন ৬ মাসের এই শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিলাম এবং সেই থেকে তাকে স্বযতেœ লালন পালন করেছি।
চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা বড় ট্রাজেডি, নিজের পিতার লাশ খুঁজতে গিয়ে মৃত মায়ের বুকের উপর একটি জীবিত শিশু খুঁজে পেলেন। যেখানে কেউ বেঁচে নেই, সেখানে এই শিশুটি প্রাণে বেঁচে যাওয়া আল্লাহ পাকের একটা বড় নিয়ামত। তাই এটিও একটি বড় ট্রাজেডি। তাছাড়া এই মহান অসা¤প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত যিনি স্হাপন করলেন সেই অবতাররূপী দেবতার নাম এরশাদ আলী মোড়ল তাকে স্বশ্রদ্ধ সালাম।