জি এম ফিরোজ উদ্দিন, (মণিরামপুর) প্রতিনিধি : প্রতি বছরের বর্ষায় খাল-বিল পানিতে টইটম্বুর। বর্ষা মৌসুম হলেও তেমন বর্ষা নেই। তার পরও নৌকা বেচাকেনার ধুম পড়েছে। খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকার কারিগররা। দিন-রাত হাতুড়ি-বাটালের ঠুকঠাক শব্দে মুখর মনোহরপুরের কুমারঘাটা নৌকা পল্লী গুলো। বর্ষা মৌসুমে নিচু এলাকার লোকজনের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা।
চারদিকে বর্ষায় যখন রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, তখন নৌকা, কলাগাছের ভেলা হয়ে ওঠে পারাপারের ভরসা। সকালে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, মনিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমারঘাটা, কপালিয়া সহ অনেক গ্রামে কারিগররা নৌকা তৈরিতে এখন বেশ ব্যস্ত। কাঠের ব্যবসায়ী ইমন কাঠগোলার মালিক মোঃ মোশাররফ গাজী বলেন, আমি পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী, আর বর্ষা এলে নৌকা বানাইয়ে বিক্রি করি।
বহু বছর ধরে এ কাজ করছি। এ সময় আমার কারিগররা দম ফেলার সময় পায় না। আমি নিজেও নৌকা তৈরি করি। জুন মাস থেকে নৌকা তৈরির কাজ শুরু হয় আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত তৈরি ও বিক্রি হয়। পানি বাড়লে বিক্রি বাড়বে। একটা নৌকা সাত থেকে বারো হাজার টাকায় বিক্রি করি। এবার ৮ থেকে ৯ হাত দৈর্ঘ্য’র নৌকা সাত থেকে দশ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নৌকা বড় হলে দামও বাড়ে। গত কয়েক দিনে আমি বেশ কয়েকটি নৌকা বিক্রি করেছি। এই বাজারে আমার বেস কয়েকটা নৌকা তৈরীর জায়গা রয়েছে। নৌকা ক্রেতারা জানান, বন্যায় নিচু সড়ক ডুবে যায়।
বিলের ধান আনা, পরিবারের সদস্যদের পারাপার করার জন্য ৯ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নৌকা কিনেছেন। নৌকার কারিগর কাঠমিস্ত্রি বিপুল, আনিচ ও রাহান জানান, তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রী, বর্ষাকালে ৩ মাস নৌকা তৈরির কাজ করেন। বর্ষায় নৌকা আর বছরের বাকি সময়টা রাজমিস্ত্রির কাজ করে চলে তার সংসার। একটা নৌকা তৈরি করতে একজনের ২ দিন সময় লাগে।
মজুরি পাই ২ হাজার ৫শ টাকা। মনিরামপুরের কপালিয়া গ্রামের কার্তিক মÐল ও মাসুদ বিশ্বাস জানান, ডোঙা তৈরির কাজ করেন ৪০ বছর। প্রথমদিকে বাড়ি বাড়ি কাজ করতেন তিনি। এরপর ২৭ বছর ধরে কাজ করছেন কুমারঘাটা বাজারে। কথা হয় কার্তিকের সাথে। তিনি বলেন, বংশ পরস্পরায় একাজ করছি। একটা ছেলে তাকেও শিখাইছি। ১০ টাকা থেকে শুরু করে এখন ৬০০ টাকা মজুরি পাই। সারা বছর কাজ চলে। বসে থাকা লাগে না। কুমারঘাটা নৌকা পল্লীর এক কারিগর মোশারফ বলেন, তিনজনে মিলে দিনে একটা ডোঙা তৈরি করি। এক হাজার টাকা থেকে ৮০০ টাকা হাজিরা পাই।
ছয় মাস এখানে কাজ করি। বাকি সময় অন্য কাজ করি। এখন বর্ষা মৌসুম তার পরও পানি নাই। এরই মধ্যে ধুম পড়েছে ডোঙা তৈরির। মাছের ঘেরে খাবার নেয়া, বিলে মাছধরা, লোক পারাপারসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয় ডোঙাগুলো। ডোঙা তৈরিতে অতি পরিচিত এখানকার কুমারঘাটা বাজার। বাজারে ২২-২৩টি ডোঙা তৈরির ঘর রয়েছে। যেখানে ব্যস্ত সময় খাটাচ্ছেন ৬০-৭০ জন শ্রমিক। এই বাজার ছাড়াও উপজেলার কপালিয়া, কালিবাড়ি, নেহালপুর ও কোনাকোলা এলাকায় চলে ডোঙা তৈরির কাজ। কুমারঘাটা বাজারের ডোঙা তৈরির অধিকাংশ শ্রমিক স্থানীয় ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত তারা এখানে কাজ করেন। বাকি ছয় মাস কাজ করেন অন্য এলাকায়।
আর স্থানীয় শ্রমিকরা এখানে কাজ করেন সারা বছর। শ্রমিকদের অধিকাংশ বংশ পরস্পরায় একাজে জড়িত। মনিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাসহ সাতক্ষীরা, বেনাপোল, বটিয়াঘাটা, কেশবপুর, ডুমুরিয়া, অভয়নগর, নড়াইল এলাকায় যায় এসব ডোঙা। ক্রেতারা এসে ৬-১২ হাজার টাকায় কেনেন এগুলো। পেরেক এবং মেহগনি, পুইয়ে, লম্বু ও খই কাটে তৈরি হয় ডোঙা। তিনজন শ্রমিক দিনে একটি করে ডোঙা তৈরি করেন। কাজ শেষে বৈদ্যুতিক মেশিনে ফিনিশিং দিয়ে রোদে শুকিয়ে কাল রং করা হয় ডোঙায়।
কুমারঘাটা বাজারে শ্রমিক খাটিয়ে প্রথম ডোঙা তৈরির কাজ শুরু করেন স্থানীয় মোস্তাক আহমেদ মোল্লা, মোঃ মোশাররফ গাজি ও মোঃ অলিয়ার রহমান। সাংবাদিককে তারা বলেন, তিন জন শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন আমার ৬টা ঘরে ১৮ জন কাজ করে। বাজারে ছয়জন মালিকের ২২-২৩টা ঘরে কাজ চলে। তিনি বলেন, ডোবা এলাকা। ফসল তেমন হয়না। সারা বছর খাল বিলে পানি থাকে। সব সময় ডোঙা বিক্রি হয়। ঘের মালিকরা কেনেন বেশি। বর্ষার চারমাস লোকজনের জিরেন (বিশ্রাম) থাকে না। একটা ডোঙায় দেড়-দুই হাজার টাকা লাভ থাকে।