ফজলুল হক, কালিগঞ্জ প্রতিনিধি : মাছে ভাতে বাঙালি আমরা কিন্তু বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের একমাত্র খাদ্য কেওড়া ভাতে বাঙালি। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের কেওড়ার খাঁটা আর ভাত হলেই দিন পার হয়ে যায়। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা অঞ্চলের আমরা অনেকেই এই ঐতিহ্যবাহী সুন্দরবনের ঐতিহ্যবাহী কেওড়া ফলটি চিনিনা।
অনেকটা স্বল্প প্রচলিত এই কেওড়া ফল পুষ্টিমানের দিক থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। উপক‚লীয় অঞ্চল ব্যতীত কেওড়া ফল আমরা অনেকেই চিনি না। আমাদের উপমহাদেশে হেঁসেলে বহুল ব্যবহৃত এক খাদ্য উপযোগী সুগন্ধি উপকরণ। কেওড়া ফুলে আছে সু মিষ্টি সুভাষ। আর তার নির্যাস দিয়েই এই কেওড়া জল তৈরি হয়। সুন্দরবনের কেওড়াফুলের মধু খেতে সুস্বাদে ভরপুর রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের কার্যকারী মহা ক্ষমতা।
বর্ষা মৌসুমে ছাড়া কেওড়া ফুলের মধু সংগ্রহ করা যায় না। প্রতি বছরে আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, মাসে মূলত উপকূলীয় অঞ্চল তথা সুন্দরবনে এই ফলটি পাওয়া যায়। তবে কেওড়া ফল খুলনা, সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও সেভাবে খাওয়ার কথা জানা যায় না। কিন্তু পশ্চিম সুন্দরবন বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের মানুষের যুগ যুগ ধরে কেওড়া ফল দিয়ে ছোট চিংড়ি অথবা মসুরের ও বুড ডাল রান্না করে খেয়ে থাকেন। বেশিরভাগই অঞ্চলের অতি পরিচিত ডেলিকেছি বলা হয় কেওড়ার খাটাকে। এই ফল এমনিতে টক আর ভিটামিন সি এর খনিস্বরুপ।
এই কেওড়া খাট্টা রান্না করতে প্রয়োজনে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার। কেওড়ার বিচির তেতো অংশ মিশে গেলেই খাট্টার স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকেই এতে গুড় অথবা চিনি দেন। বিজ্ঞাপন আবার কেওড়া ফল দিয়ে আচার আর চাঁটনি ও তৈরি করা হয় আমলকির ও তেতুলের মতো করে। এই ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বলা হয় কেওড়া ফল আমাশয় ও জ্বর দূর করে। খুলনা সাতক্ষীরা সুন্দরবন অঞ্চলেই একটু খোঁজখবর করলেই পাওয়া যায় এই ফল। এর কারণ এ অঞ্চল জুড়ে এটা অতী দেদার আছে। লবণাক্ত বনাঞ্চলের হরিণ ও বানর এবং সুন্দরবনের নোনা পানির মাছের প্রিয় খাবার কেওড়া।
কিন্তু এর পুষ্টিমানে এতই বেশি যে কেওড়া খাওয়া প্রচলন আরো প্রয়োজন। আর তা দেশব্যাপী সব অঞ্চলেই। স¤প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুন্দরবনের রিচার্জ সেলের গবেষণা প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেনের করা গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত প্রবন্ধে দেখা যায় কেওড়া ফল পুষ্টির দিক থেকে প্রচলিত সব ফলকে হারিয়ে দিচ্ছে।
এতে রয়েছে ১৩ শতাংশ শর্করা, চার শতাংশ আমিষ, ১.৫ শতাংশ চর্বি। বিজ্ঞাপনে কেওড়া আর ও মিলবে প্রচুর ভিটামিন, বিশেষত ভিটামিন সি ও এর যৌগিকগুলোকেওড়া ফল বিভিন্ন ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যেমন পলিফেনল, ফ্লোভেনয়েড, আন্হওসআয়আনইন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আনস্যাচুরেট, ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিডে পরিপুরকে কেওড়া ফলে চায়ের মতন শরীর ও মনকে সতেজ রাখার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের কার্যকারী।
কারণ চায়ের চেয়ে এর ফলে ক্যাটেকিনসহ বিবর্ণ ধরনের পলিফেনল প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, যা চনমনে অনুভ‚তি দেয়। দেশি ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিফেনল রয়েছে আমলকি আর কেওড়া ফলেই। এই ফলে সমপরিমাণ আপেল ও কমলার তুলনায় অনেক বেশি পলিফেনল ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পলিফেনল এমন একটি উপাদান যা আমাদের দেহে ডাইবেটিকস , ক্যান্সার, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ এলার্জি চোখের ছানি বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ ও ব্যথা বেদনা সহ প্রভুতি রোগ প্রতিরোধ ও উপশম করে।
কেওড়া ফলে আপেল, কমলা, আমলকির তুলনায় বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম আয়রন ক্যালসিয়াম ফসফরাস ম্যাগনেসিয়াম ও জিংকো রয়েছে। এর ফলে আরও রয়েছে ডায়রিয়া ও ডাইবেটিকস প্রতিরোধ ও ব্যাথা নাশকগূণ। উপক‚লীয় অঞ্চলের স্বল্পপরিচিত অতি ফলটি ডায়রিয়া, আমাশয় ও জ্বর সহ পেটের পীড়ায় দায়ী জীবাণুকে কার্যকর ভাবে দমন করতে পারেন। এছাড়া সুন্দরবনের ঐতিহ্যবাহী কেওড়া ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পালমিটিক আ্যসিড, আ্যস্করবাইক, পালমিটিক ও স্টিয়ারিক অ্যাসিড। এই উপাদানগুলো খাদ্যশিল্পে খাদ্য প্রতিক্রিয়া করনে ও তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
অথচ এগুলো ক্রয় করতে আমাদের গুনতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা। তাই কেওড়া ফলের প্রচলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বাড়লে সকল দিক থেকেই উপকার পাব আমরা সবাই। বর্তমানে কেওড়া ফলটি হাটে বাজারে বিক্রয় হচ্ছে ২০/ ৩৫ টাকা দামে প্রতি কেজি। তবে অতি পরিচিত না হওয়ার কারণে বিভিন্ন অঞ্চল সহ রাজধানী ঢাকা শহরে একটু বেশি বিক্রয় হচ্ছে বলে জানা গেছে।