এসএম শহীদুল ইসলাম: মোরগ ঝুঁটি, লালমুর্গা, অঞ্চল ভেদে একেক এলাকাতে ভিন্ন ভিন্ন নামে মানুষ চেনেন। সাতক্ষীরার মানুষের কাছে মোরগ ফুল হিসেবে বেশি পরিচিত। এই ফুলের ইংরেজি নাম Cockscomb flower ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম-Celosia argentea ।
প্রকৃতিতে এসেছে শীত। কিন্তু আগেই এই ফুল ফুটতে শুরু করেছে বাড়ির আঙ্গিনা, পথের পাশে, বাগানে, নার্সারীতে। এমনকি পথের ধারে।
সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা বাঙালের মোড় এলাকায় আব্দুল খালেকের চা-এর দোকানের পাশে রাস্তার ধারে দেখা গেছে ৮ফুট উঁচু একটি মোরগফুল গাছ। গাছটি মাথায় রক্তরঙা ফুল। ঠিক যেন মোগরের মাথায় যেমন ফুল দেখা যায়।
আব্দুল খালেক বলেন, গত বর্ষাকালে চারাটি আপনাআপনি জন্মায়। মোরগফুল গাছটি পরিচর্যা করি। গাছ ৮ফুট উঁচু হয়েছে। তার মাথায় এখন মোরগের ঝুঁটির মতো ফুল ধরেছে। দেখতে অপূর্ব। গাছটির অপরূপ শোভা দেখে সবাই দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মোরগফুল গাছ সাধারণত ৩-৪ ফুট উঁচু হয়ে থাকে। কিন্তু এ গাছটি ব্যতিক্রম।
জেলার বিভিন্ন স্থানে এই মোরগ ফুল ফুটতে দেখা যাচ্ছে। বাড়ির উঠান, পথের পাশে, বাগান, নার্সারীতে শোভা পাচ্ছে এই ফুল। তবে এখন বিভিন্ন নার্সারীতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এই ফুলটি।
নার্সরী সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই ফুলের চাহিদাও ভালো। এখন থেকে শুরু হয়ে শীতকাল অবধি ফুল ফুটবে গাছে। মোরগের মাথার ঝুঁটির আকৃতির জন্য এটি মোরগ ফুল হিসেবে অধিক পরিচিত।
স্থানীয় শফিকুল ইসলাম বলেন, সকালে ভোরে সুর্য উদয়ের আগে ফুটন্ত ফুলের মোহনীয় সৌন্দর্যের অপুর্ব দৃশ্য দেখা যায়। শিশির ভেজা পাতার উপরে সাদা লালসহ একাধিক বর্ণের বাহারি রং বিমোহিত করে তুলে মন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, এশিয়ার নিরক্ষয় অঞ্চল এবং আফ্রিকা আদি নিবাস হলেও বাংলাদেশে মোরগ ফুল একটি জনপ্রিয় ফুল। অঞ্চল ভেদে কোথাও কোথাও এ ফুলকে মোরগ ঝুঁটি, লালমুর্গা নামেও ডাকা হয়। ঈড়পশংপড়সন ভষড়বিৎ ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম- Celosia argentea, পরিবার-Amaranthaceae ক্রান্তীয় এশিয়ার প্রজাতি। গাছ সাধারণত ৩০-৯০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বাগানে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো হয়ে থাকে।
নানা প্রজাতির মোরগফুল রয়েছে। প্রজাতি ভেদে গাছের পাতা, শাখা-প্রশাখা, কান্ড ও ফুলের রঙ ভিন্ন হয়। লাল, কমলা, হলুদ, সাদা, সোনালি ও মিশ্র রঙের মোরগফুল দেখতে পাওয়া যায়। ফুল গন্ধহীন, উজ্বল রঙের মোলায়েম পালকের মতো। গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করে রেখে দেয়ার পর ফুল শুকিয়ে গেলেও এর উজ্বলতা নষ্ট হয় না। ফুল শেষে পরিপক্ক ফুলের মাঝে বীজ হয়, বীজ ডাটা বীজের মতো। পরবর্তী মৌসুমে বংশ বিস্তারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করে বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা যায়।
কৃষি অফিস ও বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান, মোরগফুল মূলত হেমন্ত মৌসুমের ফুল। এর আগেও ফুটে এই ফুল। তবে সাধারণত মে মাসে বীজবপন করার পর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে গাছে ফুল ধরে এবং ফুল ফুটন্ত গাছ মার্চ মাস সময় পর্যন্ত টিকে থাকে, তারপর ফুলগাছ আপনা আপনি মরে যায়।
রৌদ্র উজ্জ্বল পরিবেশ, নিষ্কাসিত ও প্রায় সব ধরণের মাটিতে এ ফুল গাছ জন্মে। বাসা-বাড়ি, অফিস, আদালত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পার্ক ও অন্যান্য স্থানে এ ফুল গাছ চোখে পড়ে। মোরগ ফুলের ভেষজ গুনাগুণ রয়েছে। অতিরিক্ত প্রস্রাব উপশমে এবং আমাশয় রোগের চিকিৎসায় মোরগ ফুল ব্যবহার হয়ে থাকে।
এশিয়ার নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল (দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মম-লীয় আফ্রিকায় এর আদি নিবাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও পাওয়া যায়। এ ফুলগাছটি স্থানীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিকভাবেই বন্যফুল হিসেবে জন্মে। এছাড়া এটিকে পুষ্টিকর সবুজ শাকসব্জী হিসেবে চাষ করা হয়। মোরগ ফুলগাছ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য (বা শস্য) হিসেবে গ্রহণ করে এবং নাইজেরিয়ার অন্যতম প্রধান পাতাযুক্ত সবুজ শাকসব্জি, যেখানে এটি Soko yokoto নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘স্বামীদের স্বাস্থ্যবান এবং সুখী করুন। এটি পালং শাকের মতো এমন স্বাদ নয়। আর্দ্র অঞ্চলে ভালো কাজ করে।
স্পেনে এটি Rooster comb নামে পরিচিত। ভারত, বেনিন, কঙ্গো এবং ইন্দোনেশিয়ায় আহার্য সামগ্রী হিসেবে পরিচিত ও ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত এটি মূলত ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রাচীনকাল থেকেই যেখানে ভারতীয়, বার্মিজ এবং চীনা উদ্যানরক্ষক বা মালী এ গাছটিকে মন্দিরগুলির নিকটে রোপণ বা চাষ করেছিলেন, যা দ্বারা বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যুক্ত ছিল এবং এটি রোপণ বা চাষের ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। দারুণ আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর এবং মখমলের মতো মোলায়েম এ রক্তবর্ণ ফুলের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেও রয়েছে।
এর ইরেজি নাম: Cocks comb flower, Red Fox, Feather Cockscomb, Red Spinach, Plumed Cockscomb, Feathery Amaranth, Woolflower, Cockscomb Century Rose, Wild Cockscomb , বাংলা নাম: মোরগ ফুল/লালমুর্গা/মোরগঝুঁটি, হিন্দি নাম: Lalmurga, মনিপুরী নাম: Haolei, তামিল নাম: Kozhi poo।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আমানুল্যাহ আল হাদী বলেন, কান্ডের ঠিক অগ্রভাগে মোরগের মাথার লাল ঝুঁটির মতো আকৃতির কারণেই এর নাম মোরগ ফুল। তবে বাংলাদেশে অঞ্চল ভেদে মোরগঝুঁটি ও লালমুর্গা নামেও পরিচিতি রয়েছে । প্রায় সর্বত্রই এটির দেখা মেলে। মোরগ ফুল বর্ষজীবি গুল্ম জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ। এ গাছটি উষ্ণতা প্রিয় এবং কিছুটা খরা সহনশীল, তাই শুকনো পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম উপায়ে বৃদ্ধি পায়। ঠান্ডার প্রতি খুব সংবেদনশীল হওয়ার কারণে হিমশীতল আবহাওয়ায় বাঁচতে পারে না।
এটি বর্ণময়-রঙিন-প্রাণবন্ত মোরগফুল গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত ঋতুর ফুল। চাষ করার দুই-তিন মাসের মধ্যেই গাছে মোহনীয় ফুল ধরে এবং গাছটি কয়েক মাসের মধ্যে প্রকৃতির নিয়মেই মৃত্যু ঘটে। ফুলগুলি প্রায় ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। পরিপক্ক ফুলের মাঝে ডাঁটা বীজের মতো বীজ হয়। প্রতিটি ফুল থেকে একটি উচ্চ সংখ্যক বীজ উৎপাদিত হতে পারে, প্রতি গ্রামে ১৫০০ বা প্রতি আউন্সে ৪৩০০০ পর্যন্ত মসৃণ-চকচকে বীজ থাকে। এটি একটি শোভাময় পল্লবগুচ্ছ ও ফুল, সর্বোপরি সৌন্দর্যবর্ধক গাছ ।
গাছের কান্ড পুরু ও নরম, দেখতে লালচে বা সাদা। শাখা-প্রশাখা বের হয়। এর গায়ে অসংখ্য গিঁঠ থাকে। পাতা লম্বা, এর শিরা-মধ্য শিরা সুস্পষ্ট এবং পাতার অগ্রভাগ বর্শার ফলা আকৃতির। চটকদার, স্বতন্ত্র এবং সূক্ষ্মতাপূর্ণ বিভিন্ন দুর্দান্ত রঙের ফুলগুলি পালকগুচ্ছ মোমবাতির শিখা, প্রবাল ও মস্তিষ্কের অনুরূপ কিছু মনে হয়। অপরূপ সুন্দর উজ্জ্বল রঙের মোলায়েম পালকের মতো ফুলগুলি অনেকগুলি ছোট ছোট ফুলের সমন্বয়ে গঠিত। বলতে গেলে, ছোট ছোট ফুলে ঠাসা মঞ্জরি। পুষ্পমঞ্জরির ধরণ হচ্ছে Spike। মোরগ ফুল ফোটে থোকায় থোকায়, উজ্জ্বল রঙের কারণে পোকামাকড় ও মানুষকে আকৃষ্ট করে তীব্রভাবে।
বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের রঙ ভিন্ন হয়। লাল, কমলা, ক্রিমযুক্ত হলুদ, হালকা বেগুনি থেকে গোলাপী, সাদা, রূপালি, সোনালী এবং কিছু ক্ষেত্রে দোআঁশলা বা সংকর বা মিশ্ররঙেও প্রস্ফুটিত হয়। বিবাহের জন্য অপূর্ব ফুলের তোড়া, টেবিল বিন্যাস এবং বহিরঙ্গনে তাজা এবং শুকনো উভয় ফুল দুর্দান্তভাবে প্রদর্শন করে তোলে। ডাঁটা গাছের মতো দেখতে মোরগ ফুল গাছের এ সুন্দর রেশমী ফুলটি গন্ধহীন এবং এ ফুল শুকিয়ে গেলেও দীর্ঘদিন যাবৎ এর উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় না। আদর্শ বীজতলায় বা এ ফুলের বীজ বপন করে মোরগ ফুলগাছের বংশ বিস্তার করা যায়।
পরবর্তী মৌসুমে চাষ করার জন্য এ ফুলের বীজকে সংরক্ষণ করা যায়। এ গাছে ফুলের পাপড়ি হয় না, তবে কিছু প্রজাতিতে Capsule আকৃতির বা ফাটিয়া যায় এমন শুকনো ফল দেখা যায়। মোরগ ফুলগাছ পর্যাপ্ত পরিমাণ ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ। চুলকানি, মুখের ঘা, অতিরিক্ত প্রস্রাব, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং রক্ত আমাশয় চিকিৎসায় এ ফুলগাছ ব্যবহৃত হয়। কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে মিষ্টান্ন, চালের পিঠা এবং মদ্যপযুক্ত পানীয় হিসেবে ফুলগুলিকে চারিত ও সুশোভিত করে ব্যবহৃত হয়। প্রায় সকল প্রকার সমৃদ্ধ মাটিতেই মোরগ ফুলগাছ জন্মে। গাছটিকে জোরে আঘাত করা এবং শামুক থেকে রক্ষা করাও জরুরি। বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ফুলের চাষ করা হয়।