এ. মাজেদ : বলাই বাহুল্য সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলার কোলঘেঁষে ৬৬ শতাংশ সুন্দরবন বাংলাদেশের এবং বাকী ৩৪ শতাংশ ভারত ভ‚খন্ডের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত।
অথচ সুন্দরবনের মধুকে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই মর্যাদা ভারত দাবি করলেও বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ঠুনকো বললেই ভুল হবেনা। সুন্দরবনের মধু এদেশের অতীত ঐতিহ্য। খাঁটি মধুর ঘ্রাণ ও স্বাদ অতুলনীয়। প্রায় বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পেশাদার মৌ চাষিরা বিভিন্ন মৌসুমী ফুলের মধু সংগ্রহ করেন। তন্মধ্যে সুন্দরবনের মধু উৎকৃষ্টমানের। মধু প্রেমীদের কাছে সুন্দরবনের খাঁটি মধুর চাহিদাও অত্যন্ত বেশি। সুন্দরবনে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গরান, খলিশা, কেওড়া ও বাইন গাছের ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে।
এরমধ্যে খলিষা ফুলের মধু সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। দেখতে সাদা, খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিগুণে ভরপুর খলিশা ফুলের মধু। সুন্দরবনের সহকারী বন সংরক্ষক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছরের এপ্রিল ও মে দুই মাস মৌয়ালরা সুন্দরবন হতে মধু সংগ্রহ করেন। ২০২০ সালে সাতক্ষীরা রেঞ্জে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫০ কুইন্টাল। পক্ষান্তরে মধু আহরিত হয়েছে ২ হাজার ৬ কুইন্টাল। অপরদিকে মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬৫ কুইন্টাল। মোম আহরণ হয়েছে ৬০২ কুইন্টাল।
রাজস্ব উপার্জিত হয় ১৫ লাখ ৪ হাজার ৮৭৫ টাকা। ৫ লক্ষাধিক টাকার অধিক রাজস্ব আয় হয়েছে। উপক‚লীয় অঞ্চলে ৪ হাজার ১৩ জন পেশাদার মৌয়াল সুন্দরবন হতে মধু আহরণ করে। বছরজুড়ে মৌয়ালদের স্বপ্ন দোলখায় সুন্দরবনের মৌচাকে। বনবিভাগের তথ্য মতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ কেজি মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়। মধু ও মোম থেকে রাজস্ব আদায় হয় ৪৬ লাখ ৮৬ হাজার ৪১৩ টাকা।
এর মধ্যে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কেজি মধু থেকে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০৫ কেজি মোম থেকে ১৩ লাখ ৩৯০ হাজার ৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়। মৌমাছিকে রক্ষা করতঃ উপযুক্ত গ্রেডের মধু পেতে এবং সুন্দরবনে মৌচাক হতে পর্যাপ্ত মধু আহরণের জন্য মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্রতি বছর। জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবে গাছে ফুল ভালো না হলে মধু উৎপাদন ব্যাহত হয়। কারণ ফুলের সঙ্গে মধু উৎপাদনের নিবিড় সম্পর্ক।
পরিচর্যা ও সংরক্ষণের ফলে ইদানীং সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, সরকারিভাবে মধু প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানির করতে পারলে বেকার সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বৈদেশিক মুদ্রা। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৌচাষী ‘সুন্দরবন মৌচাষী সমবায় সমিতি’র সভাপতি আব্দুল করিম বলেন, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত সুন্দরবনের মধু উৎকৃষ্ট মানের হওয়ায় দেশে ও দেশের বাইরে বছর জুড়ে চাহিদা থাকে সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধুর। উৎপাদিত মধু সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে বিদেশে অধিকমূল্যে বিক্রি করা যাবে।
সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে দেশ। তিনি নিউজিল্যান্ডে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ভানুকা মধুর উল্লেখ করে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মধু। প্রতিকেজি মধু ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সে তুলনায় সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু উৎকৃষ্টমানের হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে ভৌগলিক নির্দেশক পন্যের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। খলিশা ফুলের মধুর জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বমঞ্চে সুন্দরবনের পরিচিতিকে আরও বেশী তরান্বিত করবে বলে মনে করেন তিনি।
মৌমাছি ও মধু নিয়ে কাজ করা অনেক মৌয়াল মনে করেছিলেন এবছরই হয়তো জিআই স্বীকৃতি পাবে সাতক্ষীরার মধু। স¤প্রতি প্রকাশিত জিআই পণ্যের তালিকায় সর্বরোগের মহাঔষধ মধু না থাকায় কিছুটা আহুত হলেও আশার সঞ্চারে কমতি নেই মৌচাষীদের। তাদের স্বপ্ন একদিন অবশ্যই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিলবে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের তালিকায় সুন্দরবনের মধু নাম।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো মানুষের জীবিকা নির্ভর করে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের উপর। এজন্য প্রতি বছর মধু সংগ্রহের মৌসুমে অসংখ্য মৌয়াল বাঘের শিকারে পরিনত হয়। তবুও থেমে থাকে না মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের নেশা। সুন্দরবনের মধুর ঐতিহ্য ধরে রাখতে বিসিক এর তত্ত¡াবধানে উন্নত প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে মৌয়ালদের সহযোগিতা করে আসছে। জাতীয়স্বার্থে খলিশা ফুলের মধুর ঐতিহ্য বিশ্বদরবারে তুলে ধরে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্যর তালিকাধীন স্বীকৃতি আদায়ে মৌয়াল,মৌচাষী , মধু ব্যবসায়ী, ক্রেতাসহ প্রকৃতির লীলাভ‚মি সুন্দরবন প্রেমীরা বনবিভাগ ও জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।