সকাল রিপোর্ট : সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলের চিকিৎসা সরঞ্জাম। সদর হাসপাতালে ব্যবহার না করায় অযতœ অবেহলায় নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন আধুনিক এই চিকিৎসা সরঞ্জাম। ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় জব্দ হওয়ায় ওই সব সরঞ্জাম ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নষ্ট হতে বসেছে এসব মূল্যবান চিকিৎসা সামগ্রী।
একই সাথে বছরের পর বছর আধুনিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাতক্ষীরাবাসী। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত অত্যাধুনিক এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের অধিদপ্তরে বিভিন্ন সময়ে মোট ৬ বার লিখিত পত্র পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো অনুমতি পাওয়া যায়নি। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে ৪টি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন, ১৮টি নেবুলাইজার মেশিন, ৪টি আল্টাসনোগ্রাফি মেশিন, ১টি চোখ পরীক্ষার রেটিনোস্কপ মেশিন, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, স্টিল ল্যাম্প একটি, ১ সেট ডেন্টাল যন্ত্রাংশ, ১টি সাকশান ইউনিটসহ বিভিন্ন যন্ত্ররপাতি।
চিকিৎসকরা বলছে বছরের পর বছর মূল্যবান এসব আধুনিক চিকিৎসা মেশিন ও যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার না করার কারণে তা নষ্ট হতে বসেছে। ২০ ফেব্রæয়ারি সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী এস কে আশেক নওয়াজের রুমের সামনে বারান্দায় বড় বড় তিনটি বক্সে ও দ্বিতল ভবনে উঠতে সিড়ির নীচের ডানপাশ্বে আরও একটি বাক্স ধুলাবালি অবস্থায় পড়ে আছে। এছাড়া ইপিআই ভবনের দ্বিতীয় তলার সিড়ির সম্মুখে ও স্টোর রুমে বেশ কয়টি মাকসার জালবাঁধা অবস্থায় বড় বড় বাক্স রয়েছে। সেগুলি ধুলো বালি ভরা। তার ভিতরে কি আছে সেটি সিভিল সার্জন অফিসের কেউ কোন কিছুই বলতে পারেননি।
প্রধান সহকারী এস কে আশেক নওয়াজ জানান, এসব বক্সে এক্সরে ম্যাশিন না অন্য কিছু আমরা কিছুই জানিনা। তবে এই চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি নিয়ে দুদকে মামলা চলছে। যে কারনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ গুলো ব্যবহার করতে না পারায় যত্রাংশ ও মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সদর হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের একটি রুমের এক কোনে ধুলো বালি মাখা বড় দুটি ডিপ ফ্রিজ এক কোনে রাখা আছে। এছাড়া অপারেশন থিয়েটারের একটি রুমে তালা ঝুলছে। কাঁচের দরজা ও জানালায় সাদা কাগজে লেখা রয়েছে দুদকের মামলায় তদন্তাধীন।
প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজি রবিন্দ্র নাথ ঘোষ জানান, দীর্ঘ ৫ বছর ধরে প্যাথলজি বিভাগে ডিপফ্রীজ দু’টি পড়ে আছে। এছাড়া অপারেশন বিভাগেও কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে। এগুলো ব্যবহার না হওয়ায় অধুনিক এই যন্ত্রপাতির মেশিন গুলো ইতি মধ্যে অনেক কিছু নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ সুফিয়ান রুস্তম অফিসের কাজে ঢাকাতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাঃ জয়ন্ত সরকার জানান, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের বরাদ্দ হতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ক্রয়কৃত মামামাল নিয়ে অনিয়ম থাকায় দুদকে মামলা চলছে। নিয়ম অনুয়ায়ি হাসপাতালে আগে জিনিস দিবেন পরে বিল পাবেন।
কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানি ও মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ না করে সাবেক সিভিল সার্জেন ডাঃ তহিদুল ইসলামের মাধ্যমে বিল উত্তোলন করেন। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে একদিন হঠাৎ তদন্তে আসলে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে তড়িঘড়ি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে মালামাল এনে বিভিন্ন স্থানে রেখে যান। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৯ জুলাই দুদকে মামলা হয়। মামলা নং-০২। হাসপাতালে বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় কিনা তা বিবেচনা করতে সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর এ পর্যন্ত ৬ বার পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। সর্বশেষ সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সবিজুর রহমান গত ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর পত্র প্রেরণ করেন। তবে আদালতে মামলা থাকায় এসব মালামাল ব্যবহার বা বাক্স খোলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ ব্যাপারে দুদকের মামলা পরিচালনাকারী দায়িত্বরত আইনজীবী মোস্তফা আসাদুজ্জামান দিলু জানান, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মালামাল ক্রয় ও সরবরাহ সংক্রান্ত দুদকের মোট ৫টি মামলা চলমান রয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের নামে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার কার্যাদেশের মধ্যে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকাই লোপাট করা হয়।
বাকি ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ কেটে রাখা হয়। সংশিলিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোগসাজশে দুই দফায় ক্রয়কৃত মালামাল বুঝে না নিয়ে বরং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সমুদয় মালামাল বুঝে পেয়েছেন বলে স্বাক্ষর করে বিল পরিশোধ করেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা.তহিদুল ইসলাম। এতে দেখা যায় হাসপাতালে মামামাল নেই কিন্তু কাগজে কলমে অত্যাধুনিক ওই সব সরঞ্জম গ্রহন ও ক্রয় করেছেন দেখিয়ে সরকারের বরাদ্দকৃত ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা লুটপাট করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য বিভিাগ।
হঠাৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম সাতক্ষীরা এসে তদন্ত এলে দেখতে পান হাসপাতালে কোন মালামাল নেই। অথচ ক্রয় দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন। তখনি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে জালিয়াতি ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। এক পর্যায়ে দুদকের অনুসন্ধানে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের নামে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার কার্যাদেশের মধ্যে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা লোপাট করার প্রমাণ পায় দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুদকের তদন্ত চলাকালে একপর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাবেক সিভিল সার্জন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বাসিন্দা ডা.তহিদুল ইসলামের মাধ্যমে উল্লেখিত চিকিৎসা সরঞ্জাম হাসপাতালে সরবরাহ করে এবং তা তড়িঘড়ি করে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে চলে যান। এভাবে সুকৌশলে দুদকের মামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন।
মূলত তখনই এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এঘটনায় ২০১৯ সালে ৯ জুলাই দুদকে মামলা হলে তদন্ত শেষে সিভিল সার্জন ডা.তহিদুল ইসলামসহ ৯ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ মামলায় ইতিমধ্যে সাবেক সিভিল সার্জন ডা.তহিদুল ইসলাম, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষক আনোয়ার হোসেন, স্টোরকিপার এ কে এম ফজলুল হকসহ অনেকে জামিন না পেয়ে কারাভোগ করেছেন। বর্তমান মামলাটি খুলনার সেশন আদালতে বিচারাধীন। তবে বর্তমানে মামলার সব আসামিই জামিনে রয়েছেন।
আসামিরা হলেন সাতক্ষীরার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. তওহীদুর রহমান, স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক, হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ২৫/১, তোপখানা রোডের বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির কর্ণধার ঠিকাদার জাহের উদ্দিন সরকার ও তার ছেলে আহসান হাবিব, জাহের উদ্দিনের বাবা মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার আবদুস সাত্তার সরকার এবং তার ভগ্নিপতি ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশনের কর্ণধার আসাদুর রহমান, জাহের উদ্দিন সরকারের নিয়োগকৃত প্রতিনিধি কাজী আবু বকর সিদ্দিক, মহাখালী নিমিউ অ্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী এএইচএম আব্দুল কুদ্দুস। দূর্নীতি’র কারনে দুদকের এই মামলায় প্রায় ৫ বছর ধরে আধুনিক চিকিৎসার জন্য ক্রয়কৃত চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো মামলা জটিলতায় বাক্সবন্দী অবস্থায় হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও সিভিল সার্জন অফিসের বারান্দায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে।