বিলাল হোসেন, শ্যামনগর ব্যুরো : দেশের শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে লাগানো যাবে না। অথচ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা থেকে প্রতিনিয়ত ইটভাটায় শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো জন্য অভিনব কায়দায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
১৪ বছরের নিচে কোন শিশুকে ইটভাটায় ও ভারী কোন কাজ করানো আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও। তা না মেনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পেশা পরিবর্তন করে অনেক পরিবারই কাজ না পেয়ে। ইটভাটার কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে উপকূলের শিশুদের উপরে।
এসব ইটভাটায় পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারণে অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যাচ্ছে। ওদের বয়স সাত থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু শ্রমিকই শ্যামনগর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দালালের মাধ্যমে ভাটায় মাটির বাহন চালানো, কয়লা বহন এবং ইট বানানো, পোড়ানো, শুকানো ও ভ্যানে করে তা আনা-নেওয়ার কাজ করানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ মা-বাবার সঙ্গে ইটভাটার কাজে যাচ্ছে। এতে শ্রম আইন লঙ্ঘন এবং জীবন ঝুঁকির পাশাপাশি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা।
দীর্ঘ সময় সেখানে কাজ করার ফলে মাজায় ঘাড়ে ব্যাথা হয়। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হয়। রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের যথাযথ নজরদারির অভাবে ইটভাটার মালিকরা প্রতিনিয়ত শিশুদের দিয়ে এমন কাজ করানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কমমূল্যের শ্রমিক হিসাবে শিশুদের দিয়ে অধিক কাজ করানো যায় বলেই অনেক ভাটা মালিক শিশু শ্রমিকের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানা গেছে।
পাশাপাশি শিশুদেরকে কাজে নেয়ার জন্য ইটভাটার সিজনে ৬ মাস আগে থেকে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে দাদনের টাকা দিয়ে। পরিবারের কাছ থেকে শিশুদেরকে ছয় মাস কিনে নিচ্ছে ইটভাটার সদ্দার ও মালিকরা। সম্প্রতি (১৫ অক্টোবর) শ্যামনগর উপজেলার শ্রীফলকাটি গ্রামের মিজানুর রহমান স্ত্রী ২ মেয়েকে নিয়ে। ঢাকায় ইটভাটার কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ফরিদপুরে ২ বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মিজানুর রহমানের মৃত্যু হয়। স্ত্রী সাবিরা বেগম ও ২ মেয়ে মিম আক্তার (৮) জিম আক্তার (৪)মারাত্মক আহত হয়।
আহতদের প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হলে পরবর্তীতে সাতক্ষীরা মেডিকেলে পাঠানো হয়। তাদের দুই বোনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। (২৭ অক্টোবর) বিকাল ৫ টায় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ তেল পাম্পে। তেল নেয়ার সময় একটি ভ্যান গাড়িতে তিনজন শিশুকে মাল ছাওনা সহ দেখা মেলে। তারা তাদের এলাকার মানুষের সাথে ঢাকায় একটি ইটভাটায় কাজ করতে যাচ্ছে বলে জানান। ছদ্মনাম গাবুরা গ্রামের মিন্টু মালির ছেলে আরিফ (৮), একই এলাকার আলিম গাজীর ছেলে রফিক (১০), চকবাড়া গ্রামের আব্দুল্লাহ ছেলে হাসান (৯)। মুন্সিগঞ্জ আটপাড়া গ্রামের আজগার সানা বলেন, অভাবের কারণে ১১ বছরের ছেলেকে ইটেভাটায় পাঠাতে হচ্ছে।
জিনিসপত্রের যে দাম সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সদ্দারের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে। ছেলেকে তার সাথে ইটের ভাটায় পাঠাচ্ছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছু কয়েকজন ইটভাটার সদ্দারের সাথে কথা হলে জানান, ইটভাটায় কিছু কিছু কাজ আছে। যে কাজগুলো শিশুদের ছাড়া করালে টাকা বেশি লাগে। যে কারণে শিশুদের অল্প টাকা দিয়ে ইটভাটা নিবলেন যাওয়া হচ্ছে। শিশুদেরকে নিয়ে যেতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, গাবুরা থেকে প্রায় ১০ হাজারের মত মানুষ ইটভাটাই কাজ করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৮শতর মত শিশু শ্রমিক ১শত মহিলা হবে। শিশুদের পরিবার ভাটার সদ্দারের কাছ থেকে আগাম স্টাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করে টাকা নিয়ে থাকে। শিশুদের ভাটার সিজেন আসলে সদ্দারের হাতে তুলে দেয়।
কৈখালী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম জানান, কৈখালী থেকে ৭ হাজারের মতো মানুষ ইটভাটাই কাজ করতে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ২ হাজারের মত শিশু শ্রমিক, ৮০ জনের মত মহিলা হবে। এদের অধিকাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পেশা পরিবর্তন করে ইটভাটার পেশাকে বেছে নিয়েছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, বুড়িগোয়ালিনী থেকে ৮ হাজারের বেশি মানুষ ইট ভাটায় যাচ্ছে। এর মধ্যে ৭শতর মত শিশু ও ৫০ জনের মত মহিলা শ্রমিক হবে। ইউপি চেয়ারম্যানদের তথ্য অনুযায়ী শ্যামনগর উপজেলা থেকে ১ লক্ষের বেশি মানুষ ইটভাটার কাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে । এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু শ্রমিক, ২ থেকে ৩ হাজারের মত নারী শ্রমিক রয়েছে।
নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন উপকূলীয় এলাকায় শিশুশ্রম বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইটভাটায় অধিকাংশ শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। যার ফলে শিশুরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যজীবীতে ভুগছে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ কর্মরত ডা. আনিসুজ্জামান বলেন, ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। দীর্ঘ সময় সেখানে কাজ করার ফলে মাজায় ঘাড়ে ব্যাথা হয়। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হয়। রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ডাক্তার সঞ্জীব দাশ বলেন, আমরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সরকারি ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করছি যাতে কেউ শিশু শ্রমিক কাজে না লাগায়। এছাড়া যদি কেউ সঠিক প্রমাণ দিতে পারে। শিশুদেরকে কাজে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব শিশুদের দালাল চক্র এবং অমানবিক শ্রম থেকে মুক্ত করে স্বপ্ন বুননের কাজে নিয়োজিত করার দাবি সচেতন মহলের।
