সকাল ডেস্ক : “শীতের পিঠা ভাপা পিঠা আরও ফুলঝুরি, পুলির সাথে পাকান পিঠা খাবো মনটা ভরি। খেজুর রসে ভেজা চিতুই রসে টলমল, দেখলে তারে হাড়ির ভিতর জিবে আসে জল। দুধে ভেজা পদ্মপুলি রসের উপর ভাসে, তাইনা দেখে মালপোয়াটা খিলখিলিয়ে হাসে। মালাই গুড়ের ভাঁপা পিঠা পাটিসাপটা আরো, নকশি আছে ক্ষির আছে যত খেতে পারো।”
এভাবে শত পিঠার বন্দনায় সুর ও ছন্দের মূর্ছনায় রবিবার (১৯ জানুয়ারি) সকাল থেকে মুখরিত হয়ে ওঠে সাতক্ষীরার নবজীবন ইনস্টিটিউটের সবুজ চত্বর। ‘নতুন ধানে, নতুন প্রাণে, চলো মাতি পিঠার ঘ্রাণে’ এমনই কাব্যিক আবেশে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পিঠা উৎসবে মেতে ওঠে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ অভ্যাগতগণ। বাঙালির ঐতিহ্য শীতের রসের পিঠাসহ রকমারি পিঠার স্বাদে গন্ধে মন ভরিয়ে দেয় আয়োজকেরা। স্টলে স্টলে শোভা পায় বাহারি নামের নানা রঙের পিঠা।
“এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানে তারুণ্যের উৎসব ও তারুণ্য মেলা উপলক্ষে সাতক্ষীরার নবজীবন ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় পিঠা উৎসবের। পিঠা উৎসবে বিভিন্ন ধরণের দেশিয় ও আঞ্চলিক পিঠা প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীরা। অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করা হয় নানা পদের পিঠায়। তারুণ্য মেলার এ নান্দনিক আয়োজনে এঞ্জেল প্লে শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্টলে স্টলে থরে থরে সাজিয়ে রাখতে দেখা যায় শত রকমের পিঠা। এসব পিঠার স্বাদ যেমন ভিন্ন, তেমনি নামও বৈচিত্র্যময়।
যেমন- পাটিসাপটা, পোয়া, মালপোয়া, হরেক রকমের পুলিপিঠা, নকশি পিঠা, ম্যারা পিঠা, মই পিঠা, দুধ চিতই, গোলাপ পিঠা, ছিপ পিঠা, খিরসা পুলি, ফুল পিঠা, ঝাল পিঠা, সন্দেশ, ঝিনুক পিঠা, ক্ষীর পুলি, তেলের পিঠা, জামাই পুলি, তিল পনির, মোরগ পিঠা, সুন্দরী পাকন, মালাই পিঠা, পাতা পিঠা, রসফুল, লবঙ্গ পিঠা, খেজুর ফিন্নি ইত্যাদি। সহকারী শিক্ষক শামিমা সুলতানা কবি সুফিয়া কমালের ‘পল্লীস্মৃতি’ কবিতার অংশ বিশেষ আবৃত্তি করে বলেন— “পৌষ পার্বনে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, আরো উল্লাস বাড়িয়াছে যেন মায়ের বকুনি খেয়ে।”
শিক্ষক ফাহাদ হোসেন বলেন, শীত এলেই বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা তৈরির ধুম। পিঠা শুধু একটি খাবার নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক। বিভিন্ন ধরনের পিঠা যেমন ভাপা, পাটিসাপটা, নকশী, দুধ চিতই ইত্যাদি দিয়ে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে পিঠা উৎসব পালন করা হয়। শীতের পিঠা উৎসব শুধু খাবারের আনন্দ নয়, এটি মানুষের মধ্যে আনন্দের ধারা বইয়ে আনে, পরস্পরের সাথে সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করে এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করায়।
প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, শীতকালে পিঠা খাওয়ার আনন্দ, মাটির চুলায় পিঠা বানানোর উষ্ণতা, আর খেজুর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ঘরে ঘরে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়। পিঠা শুধু পরিবারের সবাইকে একত্রিত করে না; এটি নতুন প্রজন্মকে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করায় এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
নবজীবন ইনস্টিটিউটের সভাপতি, দৈনিক সাতক্ষীরার সকালের সম্পাদক ও প্রকাশক তারেকুজ্জামান খান বলেন, পিঠা শুধু বাঙালির প্রিয় খাবার নয়, এটি আমাদের শীতকালীন উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। শীতের সকাল মানেই খেজুর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে ভাপা পিঠা, নারিকেল দিয়ে ভরা পাটিসাপটা, কিংবা দুধের মিষ্টিতে ডুবানো চিতই। এসব পিঠার সাথে জড়িয়ে থাকে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্য, গ্রামের প্রকৃতির মুগ্ধতা, এবং ঐতিহ্যের নিবিড় ছোঁয়া। তাই শীত এলেই বাংলার ঘরে ঘরে পিঠার এই আয়োজন বয়ে আনে এক বিশেষ আমেজ।
তিনি আরও বলেন, নকশি পিঠা বাঙালি ঐতিহ্যের একটি বিশেষ প্রতিচ্ছবি, যা শুধুমাত্র খাদ্য নয় বরং শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। নকশি পিঠা তৈরিতে বাঙালি নারীদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য প্রকাশ পাওয়া যায়। শীতকালীন উৎসবে ঘরে ঘরে এই পিঠা তৈরি হয়, যা আমাদের গ্রামীণ জীবনের সহজ-সরল সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। খেজুর গুড়, নারিকেল, চালের গুঁড়ো, আর নানা ধরনের সজ্জা দিয়ে তৈরি করা এই পিঠা আমাদের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরে। বাংলাদেশে পিঠা আনন্দ ও উদযাপনের প্রতীক, যা শীতের সকালকে আরো উপভোগ্য করে তোলে।
শীতকালে আমাদের দেশে পিঠা-পায়েস, উদযাপনের একটি অন্যতম অংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে, বাড়ির উঠোনে পিঠা তৈরীর সেই আমেজ, নগরের এই ব্যস্তময় জীবনের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে অনেকটা। তাই অঞ্চলভিত্তিক বিশেষায়িত ও লুপ্তপ্রায় পিঠা শিল্পকে তুলে আনার লক্ষ্যে ঐতিহ্যেবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নবজীবনের এই তারুণ্য মেলায় পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নবজীবন ইনস্টিটিউটের সভাপতি, দৈনিক সাতক্ষীরার সকালের সম্পাদক ও প্রকাশক তারেকুজ্জামান খান, প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন, সহকারী প্রধান শিক্ষক শেখ মফিজুর রহমান, সিনিয়র শিক্ষক শেখ বোরহান আলী, সহকারী শিক্ষক কাজি মফিজুল হক, মাহমুদ হোসেন, সুরাইয়া পারভীন, পলাশ কুমার, আল মামুন, শাহানা খাতুন, মোস্তাফিজুর রহমান, অতনু বোস, তুহিনা সুলতানা, প্রিতম দাস, ফাহাদ হোসেন, আরিজুল ইসলাম, শামিমা সুলতানা, আজিজুল ইসলাম, মাসুম বিল্লাল, সাগর হোসেন প্রমুখ। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির সকল শ্রেণির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত করে তোলেন।