সকাল ডেস্ক : সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা জাগতিক সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যান মানব কল্যানে। মনুষ্যত্বের প্রতি তাঁদের অবদানের মাপকাঠি কোন কিছু দিয়েই নিরূপন করা যায় না। জানার প্রবল আগ্রহ আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে আপডেটেড রাখার নেশায় তিনি আজও একাগ্রচিত্তে অধ্যবসায়ে ব্যাস্ত রেখেছেন নিজেকে।
হ্যাঁ, আমরা সাতক্ষীরার আলিপুরের কৃতি সন্তান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুশান্ত ঘোষের কথাই বলছি। যিনি নিজেকে ব্যাক্তির গন্ডি থেকে পেরিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছেন। অর্থ আর খ্যাতির মোহকে দূরে রেখে যে মাটি থেকে বেড়ে উঠেছিলেন সেই মাটি-মানুষের কল্যানে আর্ত মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
১৯৫২ সালের ২০ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলার আলিপুর গ্রামের নাথপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে স্বর্গীয় কালি পদ ঘোষ এবং স্বর্গীয়া সুবর্না ঘোষের ৭ম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর বহেরা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর সাতক্ষীরা টাউন স্কুলে ১৯৬৬ সালে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সাতক্ষীরার এই বিদ্যালয়টি নির্মানে তৎকালীন ছাত্ররা স্বেচ্ছা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন।
পরবর্তীতে এই টাউন স্কুলটিই সরকারী করনের পর সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিতি পায়। ২০১২ সালে ডা. সুশান্ত ঘোষের নেতৃত্বেই সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবর্ন জয়ন্তী পালিত হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে সাইন্স থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। অতপরঃ ভর্তি হন খুলনার ঐতিহ্যবাহী বি. এল. কলেজে। ১৯৬৯ সালে সাইন্স থেকেই আবারও প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন তিনি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি এল কলেজ থেকেই বি এস সি তে ভর্তি হন এবং ১৯৭২ সালে বি এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুজিব বাহিনীতে যোগদান করেন এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করেন। বি এস সি শেষ করার পর তার সুযোগ আসে রাজশাহী চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির। মানবসেবার যে প্রত্যয় তিনি তার পরিবার থেকে পেয়েছিলেন সেই সুযোগটিকে লুফে নেন। ১৯৭৩ সালে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং বেশ ডাকসাইটে তুখোড় ছাত্র হিসেবে সকল শিক্ষকদের মন জয় করে নেন। ১৯৭৮ সালে এম বি বি এস পাশের পর বি সি এস (স্বাস্থ্য) উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকারি চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে সহকারি সার্জন হিসেবে। এখানে কর্মরত ছিলেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।
এরপর সাতক্ষীরাবাসীকে সেবা প্রদানের লক্ষে বদলী হয়ে আসলেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে এবং কর্মরত ছিলেন ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। এখানে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রæয়ারী তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফরিদপুর জেলার জাটিগ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক স্বর্গীয় নিত্য রঞ্জন ঘোষ ও সরোজ প্রভা ঘোষের দ্বিতীয় কন্যা শ্রীমতি সুলেখা ঘোষের সাথে।
এই দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান ডা. সুব্রত ঘোষ সারা দেশে সাতক্ষীরার অধিবাসী চিকিৎসক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন ডক্টরস্ এন্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস্ ফ্রম সাতক্ষীরার আহবায়ক, স¤প্রীতি বাংলাদেশ সাতক্ষীরা জেলা শাখার সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাতক্ষীরা জেলা শাখার স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক এবং কনিষ্ঠ সন্তান সংগীত শিল্পী সৌগত ঘোষ দ্রæত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিদ্যায় অধ্যয়নের পর নরওয়েতে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত। জ্যেষ্ঠ পুত্রবধু ডা. ইলিকা ঘোষ সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনি বিভাগে কর্মরত আছেন। তিনি বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশের পর গাইনিতে এমসিপিএস ও এফসিপিএস পাশ করেন।
বিবাহের পর ডা. সুশান্ত ঘোষ ১৯৮৩ সালে বাগেরহাট আধুনিক সদর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এর মাঝে প্যাথলজিতে উচ্চতর ট্রেনিং গ্রহনের জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশালে কর্মরত ছিলেন। এখানে প্রায় ১ বছর কর্মরত থাকার পর চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ইরানে দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর অবস্থান করেন এবং সুনামের সাথে চিকিৎসা প্রদান করেন।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে প্রবীন পিতা-মাতাকে দেখাশোনার জন্য দেশে ফিরে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে সাতক্ষীরাতে প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করেন এবং সাতক্ষীরার আপামর জনগনের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস্ এন্ড সার্জনস্ থেকে মেডিসিনে এমসিপিএস ডিগ্রী লাভ করেন। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক লাভ করেন।
ইরানে থাকাকালীন লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করে রয়েল কলেজ অব ফিজিশিানস্ এন্ড সার্জনস্ থেকে মেডিসিনে এমআরসিপি প্রথম পর্ব সম্পন্ন করলেও সাতক্ষীরাবাসীকে সেবা করার জন্য এখানে অবস্থান করায় এবং পারিবারিক ব্যাস্ততায় তা আর সম্পন্ন করা হয়নি। এরপর শেকড়ের টানে সাতক্ষীরার বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি আর। জন্মস্থান সাতক্ষীরাতেই শুরু করতে থাকেন মানব সেবা।
ইতোমধ্যে তিনি লাভ করেন এফআরএসএইচ এবং সার্টিফিকেট কোর্স অন এ্যাজমা ডিগ্রী। জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউট থেকে হৃদরোগের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষন, জাতীয় বাতজ্বর ইনিস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মেডিসিনে উচ্চতর প্রশিক্ষন সম্পন্ন করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা, ভারত, তুরস্ক, আইয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে কার্ডিওলজী, এইডস্, মেডিসিন, এ্যাজমা বিষয়ের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষনও গ্রহন করেন।
সনোগ্রাফি বা আলট্রাসনো’র উপরও উচ্চতর প্রশিক্ষন রয়েছে তার। সদালাপী, সমাজ সেবক, ধার্মিক এবং সৎ চরিত্রের অধিকারি ডা. সুশান্ত ঘোষ তার পৈত্রিক ভিটায় প্রতি শুক্রবার গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে। আর এ কাজে তাকে যথার্থই সহয়তা প্রদান করছেন তাঁর স্ত্রী সমাজ সেবিকা শ্রীমতি সুলেখা ঘোষ।
তিনি রোটারী ইন্টারন্যাশনাল, স¤প্রীতি বাংলাদেশ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি, জয় মহাপ্রভু সেবক সংঘ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ডোনার ক্লাব, সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী, জেলা শিল্পকলা একাজেমী, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন দেশি-আন্তর্জাতিক সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সাথে জড়িত। প্রবীন স্বাস্থ্যসেবায় সাতক্ষীরাবাসীকে সচেতন করতে সাতক্ষীরায় গঠন করেছেন সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটিতে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে অদ্যাবধী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি নিরলসভাবে সাতক্ষীরাবাসীর পাশে থেকে সেবা করতে চান। জন্মদিনে সাতক্ষীরার এই গুণী মানুষটির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবিনীত অভিবাদন।