দেবহাটা প্রতিনিধি : জীবন সংগ্রামে সমাজ, পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন দেবহাটার ৫ নারী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব অদম্য নারীদের ৫টি ক্যাটাগরিতে খুঁজেবের করেছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। এসব নারীদের জীবনে রয়েছে আলাদা আলাদা জীবন কাহিনি। তাদের সেই সংগ্রামের কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হলো: (১) বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন তাহেরা খাতুন। তিনি উপজেলার কোঁড়া এলাকার মৃত মমিনুর রহমানের স্ত্রী।
তিনি জানান, তার পিতার বাড়ি উত্তর পারুলিয়া গ্রামে। এইচ.এস.সি পাশের পরেই তার বিবাহ হয়। বিবাহের পরপরই আমাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। সংসার খুব ভাল ভাবেই চলছিল। হঠাৎ ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে একদিকে ছেলে সন্তান অন্য দিকে সংসারের দারিদ্রতা এ যেন একটি বিভীষিকা।
স্বামী হারা শোক ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে স্বামীর রেখে যাওয়া ছোট মুদির দোকানে মালামাল তুলে ব্যবসা শুরু করি। সাথে সাথে ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি এবং নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করি। আয়ের পথ খুলে যাওয়ায় বর্তমানে আমার ছেলেকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। (২) শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হেলেনা পারভীন। সে মাঘরী গ্রামের এনতাজ আলীর মেয়ে। হেলেনা ৬ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তার বাড়িতে দুইটা বোন স্বামী পরিত্যক্তা।
অভাবের পরিবারে ভাইবোনেরা প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি অগাধ আগ্রহ ছিলো হেলেনার। কারণ অন্যান্য বোনদের ছোটবেলায় বিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের সংসারে সারাক্ষণ অশান্তি লেগেই থাকতো। এসবের কারণে সে ছোটবেলা থেকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল লেখাপড়া শিখে একটা চাকরি করবে এবং পরিবারের অভাব অনটন দূর করবে। এভাবে অনেক কষ্ট করে এস.এস.সি পাশ করার পরপরই তার পিতা স্ট্রোক এ আক্রান্ত হন।
এমতাবস্থায় তার পড়াশুনা প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়। তখনই সে এক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের সহায়তায় প্যারা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি পিতার চিকিৎসা ও পরিবারের আর্থিক উন্নয়নের জন্য টিউশনি শুরু করে। খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে খুলনা বি.এল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করে সে। জীবন সংগ্রামে পিছিয়ে না পড়ে অবশেষে সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ হিসাবে নিযুক্ত হন। সেখানে থেকে তার সুদিন ফিরতে শুরু করে। (৩) সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন উত্তরা দাশ, সে মাঝ-পারুলিয়া গ্রামের জগবন্ধু দাশের স্ত্রী।
তিনি জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার এলাকায় কয়েকটি বাল্যবিবাহ বন্ধ, শিশু শ্রম ও ইভটিজিং প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে সে। সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বিশেষ করে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে উত্তরা। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সহযোগিতা পাওয়ার কাজ করে সে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানুষদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয় বর্ধন মূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি, শিশুদের স্কুলগামী করার লক্ষ্যে অভিভাবকদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা।
ব্র্যাক থেকে স্বাস্থ্যসেবার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজ এলাকায় কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালিন স্বাস্থসেবা/পরিচর্যা, প্রাকৃতিক/বিপর্যয়কালিন সময়ে করণীয়, মায়ের গর্ভকালীন পরিচর্যা, শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতকরণ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। (৪) অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী নাজমা খাতুন। তিনি নারিকেলী গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী।
তিনি জানান, দারিদ্রতার কারণে তার পিতা লেখাপড়ার খরচ বহন করতে হিমশিম খেত। তাই আমি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি ছোট বাচ্চাদের টিউশনি করতেন। ২০০৯ সালে আমার বিয়ে হলো একটি দরিদ্র পরিবারের বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর স্বামীর টিউশনির টাকা ও নিজের সামান্য টাকায় আমার সংসার অভাব অনাটনে জর্জরিত ছিল। এরপর ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) সমৃদ্ধি কর্মসূচিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে এবং তার স্বামীও স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকরি শুরু করেন।
এরপর দুজনের টাকা থেকে বাড়িতে গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগি পালন শুরু করি। প্রতি বছর গরু ও ছাগল থেকে লাভের টাকা দিয়ে ৮ শতক জমি ক্রয় করে একটি আধা পাকা বাড়ি নির্মাণ করে। বর্তমানে স্বামী, সন্তানদের নিয়ে তিনি সুখের দিন পার করছেন। (৫) সফল জননী ফাহিমা খাতুন। তিনি চকমোহাম্মাদালীপুর গ্রামের সিরাজুদ্দীনের স্ত্রী। ফাহিমা ছিলেন সমাজ সচেতন, শিক্ষানুরাগী এবং আত্মপ্রত্যয়ী। তিনি ছোট বেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি ছিলেন অদম্য অনুরাগী। ফাহিমার স্বামীর বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশদহা গ্রামে। স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না বিধায় ফাহিমা পিতার বাড়িতে পিতার দেওয়া জমিতে স্বামীসহ বসবাস করতেন।
তার স্বামী প্রথমে ১৫০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে। পরে দেবহাটা বি.বি.এম.পি ইন্সস্টিটিউশন এ ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। স্বামীর সামান্য বেতনের চাকরিতে কোন রকমে সংসার পরিচালনা করতেন। সেই সাথে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন করে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ যোগাতেন। তার ছেলে-মেয়েরা দু-জনই ছিল মেধাবী ও পরিশ্রমী। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সাথে পড়াশুনা সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ছেলে তানযিলুর রহমান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেFirst Assistant Vice president (FAVP), I.T Audit, ICC Divission Trust bank Limited, Head Office, Dhaka তে কর্মরত আর মেয়ে ডা.নাসরিন নাহার খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস ও পরে বি.সি.এস (স্বাস্থ্য) পাশ করে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনি ও অবস্ বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত আছেন।